বয়েস টা তখন অনেক কম। সবে কলেজে ফাইনাল সেমিস্টার দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছি, রেজাল্ট বেরোয়নি। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড পটাই (আসল নাম টা পরিবর্তন করলাম, কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্ক গুলো যেমন ফিকে হয়, বন্ধুত্বও তাই, আবার কারুর ক্ষেত্রে হয়তো বা হয় না। তাই আমার লেখা তার ভালো বা খারাপ যে কোনোটাই লাগতে পারে, অব্জেকশন ও থাকতে পারে। তাই কাউকে বিব্রত করতে এ লেখা নয়)। যাই হোক, এবার আসা যাক লেখায়। ঘুরতে যাবো ঠিক করলাম , জায়গা টা - দীঘা। আমি অবশ্যই এই লেখা তে কি করে দীঘা যেতে হয় বা কোথায় থাকতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি ইনফরমেশন দিতে লিখছিনা। বাঙালির জীবনে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে থাকা বাঙালি কে দীঘা নিয়ে বলতে যাওয়া টা স্পর্ধা ছাড়া আর কিছু নয়। আমাদের ছড়ানোর অধ্যায় গুলো -
দীঘার প্ল্যানিং
ক্যালেন্ডার দেখে প্রায় দিন পনেরো আগেই দেখে নিলাম একটা সোমবারে ছুটি আছে। ঠিক করেছিলাম রবিবার ভোর বেলা বেরোবো আর সোমবারে রাত্রে দীঘা থেকে ফিরে আসব। যেমন ভাবা তেমন কাজ।
ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো যাবার সেই আগের দিন, শনিবার। অফিস থেকে বাড়ি ফিরেই দৌড়লাম পটাইদের বাড়ি। আমার একটা bsa slr রেসিং সাইকেল ছিলো। ওটায় ঝড় তুলে পটাইয়ের বাড়ির দিকে যাবো, রাস্তায় সাইকেলের চেন টা পরে গেল। কোনোরকমে চেনটা তুলে, হাতের কালি টা মুছতে গিয়ে বোধয় মুখে ঘষে দিয়েছিলাম। তারপর দেখলাম রাস্তায় সবাই আমায় দেখে হাসছে, তখন বুঝলাম যে কিছু একটা কেলো হয়েছে। যাই হোক পৌঁছলাম পটাইয়ের বাড়ি। পটাই ছাদে। দেখলাম ওর মুড অফ। জিজ্ঞেস করলাম , "কি বে, কাল যাওয়া আমাদের আর তুই কিছু গোছ গাছ করিস নি ?" ও উত্তর দিলো - "ভাই একটা ক্যাচরা হয়ে গেছে"।
আমি - "কি ?"
আপনাদের কি মনে হয়? চ্যাংড়া ছেলে দুটো, ঘুরতে যাবে আর তার মাঝে ক্যাচাল? নিশ্চই প্রেম ঘটিত কেস বা অফিসের স্ট্রেস ??!!
আস্বস্ত করছি দুটোর কোনো টাই না। এসব প্রেম টেম দুজনের বন্ধুত্বের কাছে তখন পাত্তাই পায় না, তার চেয়েও বড় কথা আমাদের দুজনকেই কেউ পাত্তা দেয়না। আর, দুজনের মাইনের যোগফল তখন পাঁচ হাজার টাকাও না। আমরা না, বরং ম্যানেজমেন্টই আমাদের নিয়ে স্ট্রেসড থাকতো, যে কম পয়সাতে খাটার মুরগি দুটো যদি চলে যায়, এতো সস্তায় আর কাউকে পাওয়া যাবে না। হেহেহে : !!!
ইতিমধ্যে পটাই আমায় তার মুড অফ হওয়ার কারণ টা জানিয়ে দিয়েছে। আপনাদের বলা হয়নি আমার এই বন্ধু পায়রা পোষে - নিখাদ পায়রা প্রেমিক। বিকেল বেলা ওর মা ওকে রেশন দোকান থেকে ৫ কেজি গম আনতে পাঠিয়েছিলো। পটাই গেছিলো, গম ভর্তি থলি হাতে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করে। বাড়ি ফিরতে গিয়ে রাস্তায় একটা ভালো জাতির পায়রা উড়ে যেতে দেখে ও আঃ আঃ করে ভরি করে নামাতে চেষ্টা করে আর সেই ফাঁকে...... না মানে, ওর হাত থেকে কে যেন গম ভর্তি থলি টা নিয়ে চলে গেছে, আর পটাই বুঝতেই পারেনি। বেগতিক দেখে পটাইয়ের মা কে আমি গিয়েই অনেক কষ্টে মানালাম। থলি পর্ব শেষ আর দীঘা পর্ব শুরু............
এক্সেকিউশন
রোববার সকাল, ইনফ্যাক্ট ভোর। পটাই এসে আমায় ফ্ল্যাটের নীচের থেকে ডাকল। নেমে এলাম। আমরা বেলঘরিয়া তে থাকি। হাঁটা শুরু করলাম ডানলপ এর দিকে L9 বাস স্ট্যান্ড এ। ওখান থেকেই দীঘার বাস ছাড়ে। ও পুরো জামা টামা গুঁজে জুতো মোজা পরে একসা। মুড আজ দেখছি একদম ঠিক হয়ে গেছে। গুন্ গুন্ করছে "তেরে দর পর সনম চলে আয়ে........ " মুখে একটা বিড়ি ধরাল। কিন্তু সময় টা মনে হয় বেচারার খারাপই যাচ্ছে। টান দিতেই বিড়ি টা ফেটে ঠোঁট টা পুড়ে গেলো ওর। আমি ভাবছিলাম, এতো কিছু কেলো এখনই কেন হচ্ছে ? মনে মনে ঠাকুর প্রণাম করে বলে দিলাম আর যেন কোনো গ্যাঁড়াকল না হয়।
পৌঁছলাম বাস স্ট্যান্ড। দীঘার বাসের টিকিট কাটতে আমরা লাইন এ দাঁড়িয়েছি।
পটাই - "কাকা, দুটো দীঘা দেখি , চাকার ওপর যেন না পরে...... "
টিকিট দুটো হাতে নিয়ে লাইন ছেড়ে বেরিয়ে এসে ও টিকেট গুলো তে সিট নাম্বার গুলো দেখে হিসেবে করতে থাকলো। তার পরই কাউন্টার সামনে গিয়ে বাওয়াল শুরু।
পটাই - " ও কাকা তোমায় বললাম না চাকার ওপর না দিতে, সেই শালা তুমি চাকার ওপর দিলে। তোমরা জানো তো, ভালো কথার লোক নয়। তুমি ততদিন এখানে চাকরি করো না; যতদিন আমি এইসব গর্মেন্ট বাস চড়ছি । এই জন্যেই তোমরা ক্যালানি খাও জানো তো:...
এবার কাউন্টারের লোকটি (অবশ্যই ভদ্র লোকটি) বিরক্ত হয়ে বললেন , " বললাম তো এটা ভালো সিট , চাকার ওপর নয়......."
পটাই -" সকাল সকাল মুরগি কোরোনা, একদম সেয়ানা সাজবে না..... "
ভদ্রলোকটি এবার কাউন্টার থেকে হাত বাড়িয়ে টিকেট দুটো চেঞ্জ করে দিলেন। ওই নতুন টিকিট হাতে পেয়ে পটাই শান্ত। আমায় বললো "কোনো জায়গায় একটু না সেঁকলে কেউ কাজ করে না বুঝলি"।
এক ঘন্টা পর বাস এল ডিপো থেকে। উঠলাম, কি আশ্চর্য !! নতুন যে সিট দুটো পেয়েছি ওই দুটোই চাকার ওপরে, আর আগের টিকিটের সিট নাম্বার গুলো দেখলাম সত্যিই ভালো ছিলো। পটাই কে বললাম -" দ্যাখ কেমন লাগে , তোর ডেপোমির জন্যেই এটা হলো। একদম চুপ করে বসবি, নাহলে কানের ঝুল বারান্দায় ক্যালাবো"। পটাই একটু থ মেরে গেল। আগামী এক ঘন্টা আর কোনো কথা নেই। অনেক্ষন বাদে বললো "এই সিটটাও ভালো..." , ওর দিকে কটমট করে তাকালাম। চুপ করে গেল। তারপর বাসের টায়ার পাঙ্কচার হলো, আরো কত কি হল। সকাল সাত টার বাস দীঘা পৌঁছলো বিকেল তিনটে। পটাই কিন্তু চুপ থাকেনি , সারা রাস্তা ঝগড়া করেছে কন্ডাক্টরের সঙ্গে। আর নামার সময় ড্রাইভার কে বললো "কাকু আজ তো পুরো চাকু মেরে দিলে গো"। আমি শুনে হো হো করে হেসে উঠলাম। নেমেই বললো, "মাকরা টা সালা বাস চালালো না ভ্যানো চালালো বুঝলাম না।"
নামলাম দীঘা। সম্বর্ত বলে পটাইয়ের কোনো কলিগ এর চেনা হোটেল এ গেলাম। যে ঘরটা পেয়েছিলাম বিছানায় বোধয় কয়েক লক্ষ পিঁপড়ে ছিল তোশক এর ভেতর। গা ফুলিয়ে দিল। সেই সন্ধে আর পরের দিন সকাল টা হেব্বি মজা করেছিলাম। তখন দুজনের কাছেই আনস্মার্ট ফোন। ছবি আর তোলা হয় নি।
ফেরা টা ভালোয় ভালোয় হচ্ছিলো। তবে রাত্রে বাড়ি ঢোকার কিছুক্ষন আগেই পটাই এর পাড়ার একটা কুকুর "মানু" (নেড়ি) ওকে চিনতে না পেরে কামড়ে দিল। বাড়ি নিয়ে যেতেই পটাইয়ের বাবা ওকে সাহস দিলো আর বললো "মানুষ বেইমানি করতে পারে, মানু নয় ।" - তবে কথাটা ভুল প্রমান হলো , পরের দিন শম্ভূনাথ পন্ডিত হাসপাতালে ডাক্তারবাবু বললেন দাঁত বসিয়েছে। শেষ হলো দীঘা পর্ব আর শুরু হলো ইনজেকশন পর্ব।
উপলব্ধি
আমি প্রায় চোদ্দ পনেরো বার দীঘা গেছি, কিন্তু এই দীঘা যাওয়া টা স্মরণীয় ছিল, আজ ও আছে। কুকুর রাত্রে বেলা তাড়া করলেই মনে পরে সেই জীবনমুখী ডায়ালগ - "মানুষ বেইমানি করতে পারে, মানু নয়...."
অন্যান্য পোস্ট দেখতে হলে এখানে ক্লিক করুন।