কুয়োর ব্যাঙের কাছে সুযোগ এলো রাজস্থান যাবার। তাও আবার ফোনে প্রপোসাল টা পেলাম আমার ফটোগ্রাফি এর প্রথম শিক্ষাগুরু প্রদীপদা ( বেদজ্ঞ ) – এর কাছ থেকে। উনি খুব ভালো ফটোগ্রাফি, সিনেমাটোগ্রাফি করেন। আমায় জিজ্ঞেস করলেন “পুষ্করের মেলা দেখতে যাবে? অনেক ভালো ছবি পাওয়া যাবে।"
- রোজকার জীবনের কচকচানি
- যাত্রাশুরু
- গোলাপি শহর কে ঘুরে দেখা
- জয়শালমের-এ স্বপ্নের সময়
- পুষ্করে দিন দুয়েক
- ফিরে আসা
রোজকার জীবনের কচকচানি
আমার তখন জীবন বলতে দিনের ৩/৪ ভাগ সময় কর্পোরেট সেক্টরে চাকরি, আর বাকি সময় টা বাড়িতে ঘুমোতে আসা। ভালো ফটো মন্দ ফটো যাই তুলিনা কেনো, বেড়াবার সুযোগ টা আর হাতছাড়া করতে চাইলামনা। পুষ্করের মেলা দেখাটা মুখ্য উদ্দেশ্য হলেও জয়শালমের কে প্ল্যান এর মধ্যে জুড়ে নিলাম। ছোট বেলায় পড়া সোনার কেল্লা দেখার লোভ টা আর কোনোভাবেই সামলাতে পারছিলাম না। কারণ ওনার পক্ষে এক জায়গায় বসে ফটোগ্রাফি এর বিভিন্ন সাবজেক্ট খুঁজে পাওয়া সম্ভব থাকলেও আমার দ্বারা সেটা হতো না। আমি সেই জন্যে জায়গাগুলো ঘুরে দেখার ব্যাপারে আগে থেকেই মনস্থির করে নিলাম। সেই অনুযায়ী সমস্ত টিকিট, হোটেল বুকিং সেরে নিলাম।
যাত্রাশুরু
অবশেষে এলো যাবার দিন। বেশ সকালেরই ফ্লাইট ছিল। প্রথমে কলকাতা থেকে জয়পুর গিয়ে ওখানে তিন ঘণ্টার হল্ট। পা দিলাম রাজস্থান এ। কিন্তু কানেক্টিং ফ্লাইট রিসিডিউল হওয়ায় মোট সাত ঘন্টার মতন হল্ট টাইম পেয়ে গেলাম। লাগেজ থ্রু করাই ছিল।
গোলাপি শহর কে ঘুরে দেখা
বেরিয়ে পরলাম জয়পুর এর ঝটিকা সফরে। সিটি ট্যাক্সি নিয়ে সোজা নাহারগড় ফোর্ট। রাস্তা দিয়ে ভারতবর্ষের গোলাপি শহরের চারদিক দেখতে দেখতে চললাম । নাহারগড় ফোর্টে পৌঁছে হাঁ করে চারিদিক দেখছিলাম, আগে এরকম ফোর্ট বা কেল্লা চাক্ষুষ দেখা হয় নি। ওপরে টেরেসের মত একটা জায়গা করা আছে সেখান থেকে শহরটার অনেকখানি দেখা যায়। এ এক অন্যরকম সৌন্দর্য্য।
তারপর গন্তব্য 'হাওয়া মহল'। ভারতবর্ষের স্থাপত্য ভাস্কর্য্য নিয়ে অনেক কিছুই বই এ লেখা ছিল। কিন্তু বিশ্বাস করুন মনে রাখতে পারতাম না। তাই ভালো করে পড়াও হয়নি। তবে হাওয়া মহলের আর্কিটেকচার দেখলাম প্রানভরে। সময় কমে আসছিল, এয়ারপোর্ট ফেরবার তোরজোড় শুরু করা হলো। রাস্তায় সুন্দর 'জলমহল' পরলো। দেখলাম ছবিও তুলে নিলাম। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছিনা সব ফটো, তাই দেওয়া গেলো না এখানে। জলের মাঝে পরিবেষ্টিত আরেকটি সুন্দর স্থাপত্য, আর এর নিজস্ব রং টাই যেন আলোর বিকিরণ করেছে চারদিকে। এরপর এক জায়গায় লাঞ্চ করতে বসলাম। আমি আবার স্ট্রিক্টলি নন-ভেজ। চিকেন খুঁজে পেতে আরেকটু সময় চলে গেলো। যদিও সেটা খেয়ে মন ভরলো না। খাওয়া শেষ করে সোজা এয়ারপোর্ট। ফ্লাইট ধরে এবার জয়শালমের।
জয়শালমের-এ স্বপ্নের সময়
ওখানে পৌঁছোতে বিকেল গড়িয়ে গেলো। আলো টা কমে এসেছে। পরন্ত সূর্যের আলো ফোর্ট মানে আমাদের বাঙালি দের সোনার কেল্লার উপর পরে সোনালি রঙে যেন পুরোটা মুড়ে দিয়েছে। দূর থেকে দেখতে দেখতেই হোটেল এ ঢুকলাম। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো আমরা পুরো ট্যুরটাতেই যেখানে যেখানে নাইট স্টে করেছি রাজস্থান ট্যুরিজম বা RTDC এর হোটেল এ বুক করেছিলাম। হোটেল এ ফ্রেশ হয়ে নিয়ে সেই দিন সন্ধ্যে বেলাতেই সারাক্ষনের জন্যে একটা গাড়ি ঠিক করলাম একেবারে যাবার দিন স্টেশনে ছাড়া অবধি।
সেই সন্ধ্যে বেলাতেই বেরিয়ে পরলাম “নাথমাল কি হাভেলি" দেখতে। বলাই বাহুল্য চোখ ধাঁধানো আর্কিটেকচার। এতো সরু গলির মধ্যেই এতো বড়ো হাভেলি দেখে কিছুটা অবাকই হলাম। প্রদীপদা বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ফটো তুললেন হাভেলিটির। আমি ওখানে বিভিন্ন ধরনের জিনিস, শাড়ি, বেডকভার, সভিনিউর এসব বিক্রি হচ্ছিলো, দেখছিলাম ঘুরে ঘুরে। এক দুজন কে পেলাম যারা রাজস্থানের বিভিন্ন চলতি গীতি গুলো গাইছে একতারার মতো একটা যন্ত্র বাজিয়ে। তবে ওটা ঠিক একতারা নয়। নাম টা ঠিক জানিনা। যাই হোক, এবার ডিনার করবার পালা। নিজের জন্য একটা ভেজ থালি নিলাম। আর প্রথম খেলাম ডাল বাটি চুরমা। তবে ওখানকার নিরামিষ খাবার এর এতো ভ্যারাইটি আমার আর পুরো থাকাতে খাবার এর জন্যে আর কোনো অসুবিধা হয় নি।
পরের দিন বেরলাম সোনার
কেল্লা দেখতে। জয়শালমের ফোর্ট বা সোনার কেল্লা নিজেই যেন একটা ট্যুর প্যাকেজ। কত কি
আছে ভিতরে দেখার মতো। জোর করেই একজন গাইড আমাদের সঙ্গে চলে এলো প্রায়।
ঐতিহাসিক ব্যাপারে অতো উৎসাহ না থাকলেও সব কিছু শুনে, জানতে পেরে ভালোই লাগছিল। সকাল থেকে ঘুরতে ঘুরতে দুপুর হয়ে লাঞ্চ এর টাইম হয়ে গেলো। বেরিয়ে লাঞ্চ করে নিলাম।
তার পর গাড়ি করে গেলাম স্যান্ডডিউন বা মরুভুমি দেখতে। পরন্ত সূর্য তে কিছু ছবি তোলার চেষ্টা করা হলো, তারপর উঠের পিঠে চেপে মরুভুমিতে ঘোরা। আস্তে আস্তে সন্ধ্যে নেমে এলো। ওই স্যান্ডডিউন এর ঘোরার প্যাকেজ এই ছিল একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর তার পর ডিনার করা। রাজাস্থানের লোকগীতি গুলো স্ব-মহিমায় স্বতন্ত্র। অনুষ্ঠানটা শেষ হলে ডিনার করে হোটেল এর দিকে রওনা হলাম। পৌঁছোতে খানিক টা রাত হয়ে গেলো। পরের দিন ক্লান্ত হয়ে গিয়ে জয়পুর ফোর্ট এর আশেপাশে ঘুরে দেখে, বাড়ির জন্য অল্প শপিং করেই হোটেলে ফিরে গেলাম। রাত্রে ট্রেন ধরে রওনা হলাম আজমীঢ় এর উদ্দেশ্যে । আর মনে মনে বলে গেলাম আবার আসবো। পরবর্তী গন্তব্য পুষ্করের মেলা।
পুষ্করে দিন দুয়েক
আজমীঢ় নেমে ট্যাক্সি ধরে গেলাম বুক করা রাজস্থান ট্যুরিজম এর হোটেলে। রাস্তায় আজমীঢ় শারিফ পরলো, নমস্কার জানিয়ে চললাম সোজা পুষ্কর। হোটেলে ফ্রেশ হয়ে, লাঞ্চ করে বেরোলাম উট কেনা বেচার পুষ্করের মেলা দেখতে। অনেক লোকের জনসমাগম। অনেক উট। তারা কেউ খেলা দেখাচ্ছে, কেউ এক মালিক এর থেকে অন্য মালিকের হাতে হস্তান্তরিত হচ্ছে। ঘুরে ঘুরে সব মেলা টা দেখতে বেশ রাত্রিই হলো। দেশ বিদেশের ফটোগ্রাফার এ ভর্তি। তাদের মধ্যে আমিই বোধহয় সবচেয়ে খারাপ ফটো তুলি। কারন ওদের মতো যা দেখছি তাই ফটো তোলার ইচ্ছে আমার লাগলো না। ফিরে এলাম হোটেলে। ডিনার করে ক্যামেরা টা নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পরলাম।
পর দিন সকালে বেরোলাম আশপাশ টা ঘুরে দেখতে। ওখানকার লোকজন, ঘর বাড়ি, লোকালয় এগুলো সব দেখছিলাম। আমাদের চেয়ে জীবনযাত্রা খাওয়া দাওয়া পোশাক পরিচ্ছদ কিছুটা অন্যরকম, কিন্তু এটাই তো আমাদের দেশ এর বৈশিষ্ট্য। ফেরার পথে মেলার পাশে যেখানে উটের আস্তানা সেটাও দেখতে গেছিলাম। তবে খুব ধুলো হওয়ায় বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারিনি, কারন আমার ডাস্ট এলার্জির অসুবিধা আছে। বাঞ্জারাদের গান শুনলাম । তারপর দেখলাম ব্রহ্মা মন্দির, ভারতবর্ষে একমাত্র এখানেই ব্রহ্মদেব পূজিত হয়। এরপর ফিরে এলাম হোটেলে। রেডি হয়ে যাত্রা শুরু করলাম জয়পুর এয়ারপোর্ট এর উদ্দেশ্যে । রাস্তায় একটা লাঞ্চ ব্রেক নিয়ে পৌঁছলাম জয়পুর এয়ারপোর্ট এ, ঘন্টা চারেকের গাড়ি জার্নি শেষ হলো।
ফিরে আসা
সন্ধ্যে বেলার ফ্লাইট ধরলাম
কলকাতার জন্যে। রাজস্থানের জন্য এক টুকরো ভালোবাসা মনে নিয়ে চললাম কলকাতা। পরের বার
বাড়ির সবাইকে নিয়ে আসবো এইটুকু বলেই রাজস্থান ছাড়লাম।
অন্যান্য পোস্ট দেখতে হলে এখানে ক্লিক করুন।
ভ্রমণের কাহিনী সহজ ভাষায় খুব সুন্দর হয়েছে, পড়তে পড়তে বেড়ানোর জায়গার সাথে যেনো খুব সহজেই যোগ স্থাপন হয়ে যাচ্ছিল আর ছবি গুলো তো এক কথায় অনবদ্য।
ReplyDeleteThank You🙏🏻
Deleteলেখা দারুণ হয়েছে সাথে ছবি গুলো ❤
ReplyDeleteDarun...mone holo ar Akbar tor sathe o ghure alam...🤗👍😍
ReplyDelete